Press ESC to close

দুয়ার্তে বারবোসার চোখে ১৫১৫ সালের চট্টগ্রাম

দুয়ার্তে বারবোসা, এক পর্তুগিজ অভিযাত্রী, ১৫১৫ সালে চট্টগ্রামের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর লেখায় উঠে আসে এক স্বাধীন মুসলিম বন্দরনগরীর চিত্র, যেখানে আরব, পারস্য, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বণিকরা বাণিজ্য করতেন। উন্নত বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির কারণে চট্টগ্রাম ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

দুয়ার্তে বারবোসা ছিলেন একজন পর্তুগিজ অভিযাত্রী, যিনি ১৫১৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর লেখায় বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সে সময় এটি ছিল এক স্বাধীন মুসলিম নগরী, যেখানে বিভিন্ন জাতির মানুষের বসবাস ছিল এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।

চট্টগ্রাম কার্যত বাংলার অন্তর্ভুক্ত হলেও এটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতো। মুসলিম শাসকদের নেতৃত্বে শহরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এখানে বসবাস করতেন মুসলমান, হিন্দু, আরব, পারস্য, আবিসিনিয়া এবং আরও অনেক দেশের ব্যবসায়ী ও নাবিক। শহরের স্থাপত্য ও জীবনযাত্রায় আরব ও পারস্যের সংস্কৃতির গভীর প্রভাব দেখা যেত।

এটি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র। মালাক্কা, সুমাত্রা, চীন, ক্যাম্বে (গুজরাট), পেগু (বর্তমান মিয়ানমার) ও সিংহল (শ্রীলঙ্কা) থেকে জাহাজ এসে এখানে নোঙর করত। বিশাল আকৃতির ‘জুনকো’ নামে পরিচিত জাহাজগুলোয় তুলার কাপড়, মশলা, শুকনো মাছ, চিনি ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লোড করা হতো। চট্টগ্রামের কাপড় ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিশেষ করে মিহি সুতার তৈরি কাপড়, যা মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত রপ্তানি হতো।

এই নগরীর বস্ত্রশিল্প ছিল এতটাই উন্নত যে এখানকার কাপড় থেকে আরবদের পাগড়ি তৈরি করা হতো। এখানে উৎপাদিত কাপড়ের মধ্যে এন্তাভারেস, মামোনা, দুগল, চৌতারি এবং সিনাবাফা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কাপড় দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। চট্টগ্রামের অর্থনীতির ভিত্তি এই শিল্পের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল।

এখানে চিনিশিল্পও ছিল অত্যন্ত উন্নত। আখ থেকে প্রস্তুতকৃত সাদা চিনি তখনকার সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ চাহিদাসম্পন্ন ছিল। মালাবারের বাজারে এই অঞ্চলের চিনি উচ্চমূল্যে বিক্রি হতো। চিনির পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন ধরনের শুকনো মাছ ও অন্যান্য কৃষিপণ্যও রপ্তানি করা হতো।

শহরের জীবনযাত্রা ছিল বিলাসবহুল। ধনী মুসলমানরা মিহি কাপড় পরতেন, কোমরে রেশমের বেল্ট বাঁধতেন এবং সোনার কারুকার্য করা ছোরা বহন করতেন। তারা মুক্তহস্তে ব্যয় করতেন এবং আরামপ্রিয় জীবনযাপন করতেন। নারীদের জীবনযাত্রা ছিল সংরক্ষিত, তবে উৎসব ও বিশেষ অনুষ্ঠানে তারা বাইরে বের হতেন এবং আনন্দ-উৎসবে অংশ নিতেন। তালগাছের রস থেকে তৈরি স্থানীয় মদ তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, যা বিশেষ অনুষ্ঠানে পান করা হতো।

চট্টগ্রামের ব্যবসার একটি অংশ ছিল দাসপ্রথা। বারবোসা উল্লেখ করেছেন, এখানকার ব্যবসায়ীরা তরুণ ছেলেদের সংগ্রহ করত এবং তাদের খোজা (Eunuch) বানিয়ে উচ্চমূল্যে বিক্রি করত। এসব খোজারা সাধারণত রাজাদের অন্তঃপুর রক্ষার দায়িত্ব পালন করত এবং প্রশাসনের উচ্চপদেও আসীন হতো।

শহরে ইসলামের প্রসার ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন কিছু সংখ্যক ধর্মহীন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করত এবং মুসলিম শাসকদের আনুকূল্য লাভ করত। ফলে ইসলামের প্রভাব চট্টগ্রামের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রবেশ করেছিল।

১৫১৫ সালের চট্টগ্রামের যে চিত্র বারবোসা এঁকেছেন, তা থেকে বোঝা যায় এটি ছিল কেবলমাত্র একটি সমুদ্রবন্দর নয়, বরং এটি ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, যা সমগ্র বাংলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বারবোসার বিবরণ শতভাগ নির্ভুল না হলেও, এটি চট্টগ্রামের ইতিহাস বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এটি আমাদের একটি সমৃদ্ধ অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে চট্টগ্রাম শুধু বাংলার নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আজকের চট্টগ্রাম অনেক বদলে গেছে, কিন্তু তার ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস আজও এই নগরীর আত্মায় রয়ে গেছে।

Hossain Nur Shakib

Hi, I’m Hossain Nur Shakib - a passionate and cultural enthusiast about Chittagong. My work centers on capturing the unique history, lifestyle, and stories of Chittagong’s vibrant communities. Through my articles, I aim to connect readers with the local heritage, bringing out insights that make our region special. When I’m not writing, I’m likely exploring hidden gems around the city or engaging in community initiatives.